
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নতুন করে বড়সড় ভাঙন ধরেছে। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ থেকে এক ব্যক্তির গ্রেপ্তারের পর গোটা দেশজুড়ে আলোড়ন পড়ে গেছে। ধৃত ব্যক্তির নাম শাহজাদ, যাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ATS (Anti-Terrorism Squad) আটক করে। তদন্তে উঠে এসেছে এক গভীর ষড়যন্ত্র, যার পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা ISI-এর মদত এবং সুপরিকল্পিত ছক।
শাহজাদের মুখোশের অন্তরালে এক দেশদ্রোহী
শাহজাদ, যাকে প্রথমে সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে ধরা হয়েছিল, তদন্তে উঠে আসে তার প্রকৃত পরিচয় — সে আসলে পাকিস্তানের হয়ে কাজ করা এক গুপ্তচর। শাহজাদের প্রধান কাজ ছিল ভারতীয় মোবাইল নম্বর তথা সিম কার্ড অবৈধভাবে সংগ্রহ করে তা পাকিস্তানে পাচার করা। এই সিম কার্ডগুলি ভারতীয় নাগরিকদের নাম-পরিচয় ব্যবহার করে কেনা হতো, যাতে সন্দেহ কম হয়। পাকিস্তানি গুপ্তচররা এই সিম কার্ড ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপ কল, চ্যাট, এবং অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে ভারতের সেনা বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করত।
শুধু সিম পাচার নয়, শাহজাদ আর্থিক লেনদেন এবং ভারতীয় নাগরিকদের প্রলোভন দেখিয়ে পাকিস্তানে পাঠানোর কাজেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। সে এমন কিছু ব্যক্তিকে খুঁজে বের করত, যারা জনপ্রিয়তা বা অর্থের লোভে সহজেই বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা দিত। এইভাবে ধীরে ধীরে সে তৈরি করে এক সুসংগঠিত গোপন চক্র।

পাকিস্তান হাইকমিশনের ভূমিকা
তদন্তে সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, শাহজাদের সঙ্গে পাকিস্তান হাইকমিশনের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। হাইকমিশনের এক কর্মচারী দানিশ, যার আসল নাম এহসান-উর-রহমান, এই গোটা ষড়যন্ত্রের অন্যতম মূলচক্রী। দানিশ ছিলেন আইএসআই-এর হয়ে কাজ করা একজন গুপ্তচর, যিনি ভারতে অবস্থানকালে শাহজাদের মাধ্যমে সিম কার্ড সংগ্রহ করতেন। তিনি এমনভাবে সিম কার্ড চেতেন যাতে সেগুলি ভারতীয় নাগরিকদের নামে থাকত — এতে সন্দেহ এড়ানো যেত। এই সিম কার্ড ব্যবহার করে পাকিস্তানি গুপ্তচরেরা নির্দ্বিধায় ভারতে বসে সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদান করতে পারত।
ইউটিউবার জ্যোতি মলহোত্রার জড়িত থাকার বিস্ময়কর তথ্য
এই গোটা চক্রান্তের সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ হলো, ভারতেরই এক জনপ্রিয় ইউটিউবার জ্যোতি মলহোত্রার এতে জড়িত থাকা। হরিয়ানার হিসার জেলা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে পাকিস্তান হাইকমিশনের অফিসারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। তারা তাকে ইউটিউব ভিউ, সাবস্ক্রাইবার ও জনপ্রিয়তার লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে। জ্যোতি সেনা ঘাঁটি, কৌশলগত এলাকা, এবং সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ে ভিডিও তৈরি করে তা তাদের পাঠাত।
জিজ্ঞাসাবাদে জ্যোতি স্বীকার করেছে যে, সে শুধুমাত্র ভিডিওই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সেনা ও প্রশাসনের গোপন তথ্যও শেয়ার করত। এই ধরনের তথ্য দেশীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক এবং ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
তদন্তের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
বর্তমানে জ্যোতির মোবাইল, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ডিভাইস ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি মনে করছে, এগুলি থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে, যা এই গুপ্তচরচক্রের অন্য সদস্যদের খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। এদিকে ATS ও IB যৌথভাবে তদন্ত শুরু করেছে এবং একাধিক দিক থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন ও নাগরিকদের দায়িত্ব
এই গোটা ঘটনা ভারতের জন্য এক কঠিন সতর্কবার্তা। এতে স্পষ্ট হয়েছে, কিভাবে পাকিস্তান ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সহজ-সরল নাগরিকদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ব্যবহার করে। এটি কেবল সেনা বা পুলিশ নয় — আমাদের সকলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
প্রতিটি নাগরিকের উচিত, অজানা বা সন্দেহজনক নম্বর থেকে কল বা মেসেজ পেলে তা প্রশাসনকে জানানো। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা যদি সেনাবাহিনী সম্পর্কিত তথ্য জানতে চায় বা ভিডিও তৈরি করতে বলে, তাহলে তা অবশ্যই যাচাই করা দরকার।
উপসংহার
শাহজাদ, দানিশ এবং জ্যোতির মতো ব্যক্তিরা আমাদের দেশের ভেতরে থাকা ছদ্মবেশী শত্রু। তাদের ষড়যন্ত্র শুধু রাষ্ট্রবিরোধী নয়, জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত। এই চক্রান্তের গোড়া থেকে শিকড় উপড়ে ফেলাই এখন সময়ের দাবি। এর জন্য প্রয়োজন প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ, গোয়েন্দা সংস্থার সজাগ দৃষ্টি এবং নাগরিকদের সচেতনতা। আমরা যদি সবাই একসাথে সচেতন হই, তবে ভবিষ্যতে এমন দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।